প্রিন্ট এর তারিখঃ মার্চ ১৪, ২০২৫, ২:২০ পি.এম || প্রকাশের তারিখঃ নভেম্বর ১৩, ২০২২, ১২:০৯ পি.এম
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ফুলবাড়ীর পরিবেশ বান্ধব জীবিকায়নে।
জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব বিবেচনায় বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ একটি দেশ। জার্মান ওয়াচ গ্লোবাল-এর জলবায়ু ঝুঁকি সূচক (সিআরআই-২০২১) অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশ শীর্ষ দশ দেশের একটি। ঝুঁকি ও ক্ষতিগ্রস্তের দিক বিবেচনায় এ দেশের অবস্থান সপ্তম। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দেশের উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা, কৃষি এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পাশাপাশি প্রভাব পড়েছে পরিবেশ বান্ধব জীবিকায়নে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এ অঞ্চলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি খাতে লেগেছে ধাক্কা। দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনে উৎপাদন, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা, পরিবহন, নির্মাণ ও কৃষি খাত উল্লেখযোগ্য অবদান রাখলেও এ উপজেলার অর্থনীতি কৃষি নির্ভর।
ভারতীয় সীমান্ত ঘেষা এ উপজেলার মোট আয়তন ১৬৩ দশমিক ৬৩ বর্গকিলোমিটার। মোট জনসংখ্যা ১ লক্ষ ৪০ হাজার ৩৯২ জন এবং মোট আবাদি জমি ১২ হাজার ৪৪৫ হেক্টর। এসব জমিতে ধান, পাট, ভুট্টা ও শাক-সবজি চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করেন প্রায় ৩৮ হাজার কৃষক পরিবার। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রান্তিক কৃষক। ব্যাহত হচ্ছে এ অঞ্চলের কাঙ্ক্ষিত কৃষি উৎপাদন। এছাড়াও হাঁস মুরগী, গবাদিপশু পালনসহ মৎস্য চাষের মতো পরিবেশ বান্ধব জীবিকায় টিকে থাকাও কঠিন হয়ে পড়ছে দিনে দিনে।
সাম্প্রতিক কালে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়েছে উপজেলার ধান, পাট, ভুট্টাসহ শাক-সবজি চাষিদের। গত ইরি-বোরো মৌসুমে অসময়ের অতিবৃষ্টিতে চরম বিপাকে পড়েছিলো গোটা উপজেলার কৃষক। বোরো খেতের পাকা ধান, শাক-সবজির খেত পানিতে তলিয়ে বহু কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খেতের ফসল ঘরে তুলতে গিয়ে বজ্রাঘাতে কৃষক হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে।
টানা বৃষ্টিতে চাষিরা খেতের ভুট্টা সময় মতো ঘরে তুলতে পারে নি এবং আমনের বীজতলা বাঁচাতেও হিমসিম খেতে হয়েছে। অতিবৃষ্টির কারণে ব্যাহত হয়েছে পাট চাষাবাদ। কয়েক দিন পরেই আবার দেখা গেছে উল্টো চিত্র। দেখা দিল খরার খরগ। পানির অভাবে পাট জাগ দিতে ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে পাট চাষিদের। খরার কারণে থমকে ছিল আমন চাষাবাদ। জলবায়ু পরিবর্তনের এমন প্রভাব মোকাবিলা করে চলছে কৃষকের সংগ্রাম।
খরার করাল গ্রাস কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই চাষাবাদে এবারে বাঁধ সেধেছে তাপমাত্রা। দিন ও রাতের তাপমাত্রায় অস্বাভাবিক তারতম্যে রোগাক্রান্ত হয় ধানখেতসহ শাক-সবজির খেত। আর খেতের ফসল বাঁচানোর তাগিদে স্বাস্থ্যঝুঁকির তোয়াক্কা না করে কৃষকরা নির্দ্বিধায় ফসলের খেতে কীটনাশক প্রয়োগ করতে থাকেন। ফলে চাষাবাদের খরচ বৃদ্ধির পাশাপাশি নষ্ট হয় উৎপাদিত ফসলের পুষ্টিগুণ। এছাড়াও রোপা আমন চাষাবাদের শেষ মুহূর্তে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং এর প্রভাবে অনেক কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
আর উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে 'খেতের ফসলে ছিটানো কীটনাশক মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। খাদ্যের মাধ্যমে ক্ষতিকর উপাদান মানুষের দেহে প্রবেশের ফলে চর্ম, কিডনি, ক্যান্সার, হার্ট অ্যাটাকসহ বিভিন্ন রোগের প্রকোপ বাড়াচ্ছে। আগে মৌসুমে ভেদে ডায়রিয়া, বসন্ত, নিউমেনিয়া, চোখ উঠা রোগ দেখা গেলেও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বর্তমানে সারা বছরই মানুষের শরীরে এসব রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে'।
এদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাবের কারণে ধরলার ভাঙনের তীব্রতায় ক্রমেই বদলে যাচ্ছে ফুলবাড়ীর মানচিত্র। বিপর্যস্ত হচ্ছে উপজেলার ধরলা নদী অববাহিকায় বসবাসরত মানুষের জীবন জীবিকা। প্রতিবছর টানা বৃষ্টি আর উজান থেকে নেমে আসা ঢলে সৃষ্ট বন্যার পানিতে তলিয়ে যায় উপজেলার নাওডাঙ্গা, শিমুলবাড়ী, বড়ভিটা ও ভাঙ্গামোড় ইউনিয়নের বিস্তৃর্ণ এলাকাসহ নিম্নাঞ্চল। বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি গবাদিপশু নিয়ে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হয় বন্যা কবলিত এলাকার বাসিন্দাদের। বন্যার করাল গ্রাস থেকে বাদ যায় না মৎস্য চাষিরাও।
ভেঙে পড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা। বিপর্যস্ত হয় জনজীবন। পরে সর্বগ্রাসী রূপে দেখা দেয় ধরলার ভাঙন। ধরলার অব্যাহত ভাঙনে দীর্ঘ হয়েছে নিঃস্ব মানুষের তালিকার। এবারের ধরলার ভাঙনে বসতভিটা হারানো বড়ভিটা ইউনিয়নের পশ্চিম ধনিরাম গ্রামের বাসিন্দা আলতাফ হোসেনের বাড়ি ও বসতভিটা ভেঙেছে এ যাবৎ ষোল বার। এখন আর তার কোন জমিজমা নেই। পরিবার নিয়ে কোথায় যাবেন ভেবে পাচ্ছেন না। একই ইউনিয়নের পূর্ব ধনিরাম গ্রামের রহমত আলী বর্তমানে নিঃস্ব। তার ২৫ বিঘা ফসলি জমি ছিল। কোন কিছুর অভাব ছিল না।
পরিবার পরিজন নিয়ে সুখে শান্তিতে দিন যাপন করতেন। ধরলার তীব্র ভাঙনে একে একে তার সব জমি নদীতে বিলীন হয়েছে। অতীতের স্মৃতি চারণ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। ধরলার ভাঙন রোধে কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়ার ফলে রহমত আলীর মত এমন অনেককেই নিঃস্ব হয়ে কাঁদতে হচ্ছে প্রতিনিয়তই। ভাঙনের ফলে সোনাফলা ফসলি জমি হচ্ছে ধূ ধূ বালুচর। নদীতে বিলীন হচ্ছে বসতবাড়ি, ফসলি জমি, স্কুল, রাস্তাঘাট।
এভাবে বদলে যাচ্ছে মানুষের পেশা। বাঁচার তাগিদে পাড়ি দিচ্ছেন দেশের বিভিন্ন এলাকায়। কেউ কেউ বসতি গড়েছেন বাঁধে অথবা রাস্তার ধারে, সরকারের আবাসন প্রকল্পের ঘরে। হয়ে যাচ্ছেন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। এ উপজেলা ভারতীয় সীমান্তবর্তী হওয়ায় জীবিকার তাগিদে অনেকেই জড়িয়ে যাচ্ছেন মাদক চোরাকারবারিতে।
নদীতে বাঁধ নির্মাণের দাবিতে নদী ভাঙনে সর্বহারা জনগোষ্ঠী গত ১৪ অক্টোবর ধরলার তীরে ও কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেন। এ দাবির বাস্তবায়ন খুব জরুরি। নইলে প্রতিনিয়তই তাদের ঘরবাড়ি ও আবাদি জমি হারাতে হবে।
পরিবেশের এ বিপর্যয় রোধ করতে সামাজিক বনায়ন কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা জরুরি। উপজেলার সকল সড়ক, খাস জমি, অফিস ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চত্বরে পর্যাপ্ত দেশীয় জাতের বৃক্ষ রোপন করতে হবে। এজন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে বন বিভাগকে। জমির আইলে পরিবেশ বান্ধব বৃক্ষ রোপনে কৃষককে উৎসাহিত করতে হবে। এর ফলে খেতে পাখি ও উপকারী কীট পতঙ্গের বিচরণ বাড়ায় ক্ষতিকর পোকার উপদ্রব কমবে। জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদে কৃষককে দক্ষ করে।