
তারেক হাসান, জবি প্রতিনিধি:
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের স্পষ্ট করে বলা আছে, প্রতি বছর সিন্ডিকেটে অনুমোদনের জন্য বার্ষিক বাজেট পেশ করবেন যদি ট্রেজারার। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর নিয়োগ পাওয়া সকল ট্রেজারারে আইন মানলেও বর্তমান ট্রেজারার অধ্যাপক ডক্টর কামাল উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে এ আইন নামানোর অভিযোগ উঠেছে তার মেয়াদের গত তিন অর্থবছরে বাজেট সিন্ডিকেট উপস্থাপন করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ হিসাব দপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ডক্টর কাজী নাসির উদ্দিন। তবে বিষয়টিতে কোন সমস্যা নেই বলে দাবি কামাল উদ্দিন আহমেদের।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক কয়েকজন ট্রেজারারসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিষয়টি আইন বহির্ভূত। বাজেট উপস্থাপনে ট্রেজারারের ‘অদক্ষতা ও অর্থ পরিচালকের ওপর নির্ভরতা’কে দায়ী করছেন তারা। এর আগে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এক রায়ে উল্লেখ করেন, এই ট্রেজারার ‘প্রশাসনিকভাবে অদক্ষ’। তবে বাজেট পেশে আইন না মানার বিষয়টি নজরে এসেছে ও সামনের বাজেট ট্রেজারারই পেশ করবেন বলে মনে করছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য।
এদিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০০৫ এর ১২ (৫) ধারায় বলা আছে, ‘সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ সাপেক্ষে ট্রেজারার বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পত্তি ও বিনিয়োগ পরিচালনা করবেন। এবং তিনি বার্ষিক বাজেট ও হিসাব-বিবরণী পেশ করার জন্য সিন্ডিকেটের নিকট দায়ী থাকবেন।’ তবে ২০২০-২১, ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ (সর্বশেষ বাজেট ১৪৭ কোটি ৩৩ লাখ টাকা) অর্থবছরের বাজেট অনুমোদনের জন্য সিন্ডিকেটে পেশ করেন অর্থ ও হিসাব দপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ড. কাজী নাসির উদ্দীন। তিনি বাজেটের শেষে উল্লেখ করেন, বাজেট প্রণয়নে ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. ইমদাদুল হকের বাস্তবভিত্তিক প্রায়োগিক মতামত এবং ট্রেজারার অধ্যাপক ড. কামালউদ্দীন আহমদের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজস্ব বিচার বিবেচনার নিরিখে ফান্ড ব্যবস্থাপনার নির্দেশনার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। এছাড়া বাজেট টিমের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। একইসঙ্গে বাজেট অনুমোদনের জন্য বিনীতভাবে পেশ করছি।
সুতরাং গত তিনটি বাজেটই পেশ করেছেন অর্থ পরিচালক। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে নিয়োগের তিন বছরে একটি বাজেটও নিজে পেশ করেননি ইংরেজির অধ্যাপক থেকে ট্রেজারার পদে নিয়োজিত ড. কামালউদ্দীন আহমদ।
অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়টির বিগত অর্থবছরগুলোর বাজেটের নথি রয়েছে। সেখানে দেখা যায়, সকল ট্রেজারারই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন মেনে বাজেট পেশ করেছেন। যেমন- ২০০৭-০৮, ২০০৮-০৯ অর্থবছরের নথিতে দেখা যাচ্ছে, বাজেট পেশ করেন তৎকালীন ট্রেজারার অধ্যাপক ড. আবু হোসেন সিদ্দিক। এছাড়া ২০১০-১১, ২০১১-১২ অর্থবছরে বাজেট নথিতে দেখা গেছে, বাজেট পেশ করেছেন তৎকালীন ট্রেজারার অধ্যাপক ড. মো. শওকত জাহাঙ্গীর। একইভাবে সর্বশেষ সাবেক ট্রেজারার অধ্যাপক ড. সেলিম ভুঁইয়া ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত মোট ৮টি বাজেট নিজে সিন্ডিকেটে পেশ করেছেন। বাজেটের নিচে তাদের সাক্ষর উল্লেখ রয়েছে।
এর আগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকের টেন্ডার নিয়ে ঠিকাদারদের মধ্যে ঝামেলা বাঁধলে মীমাংসার জন্য বিষয়টি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে যায়। শুনানি শেষে গত বছরের ২০ জুলাই রায়ে মন্ত্রণালয় বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার ‘প্রশাসনিকভাবে অদক্ষ’। বিশ্ববিদ্যালয়ের টেন্ডারের টেক কমিটি থেকে তাকেসহ ৪ জনকে বাদ দেয়ার সুপারিশও করা হয়।
অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ পরিচালক ড. নাসির উদ্দীনের বিরুদ্ধে একাধিক দুর্নীতির তথ্য ইতোমধ্যে বের হয়েছে। তার মেয়াদও অনেক আগে শেষ হয়েছে। বিতর্কিত এই ব্যক্তিকে সরিয়ে আরেকজনকে নিয়োগের কথা একাধিকবার উঠেছে শিক্ষক সমিতি থেকেও। তবে ট্রেজারার নির্ভরতায় স্বপদে নির্ভার রয়েছেন নাসির উদ্দীন।
বাজেটের বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ ও হিসাব দপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ড. নাসির উদ্দীন বলেন, আমি অর্থ কমিটির সদস্য সচিব। ট্রেজারার স্যার আমাকে বলেছেন বাজেট তৈরি করতে। সেটা সিন্ডিকেটে উপস্থাপন করেছেন স্যার। এদিকে ট্রেজারারের স্থানে বাজেট অনুমোদনে অর্থ পরিচালকের নিজের পেশ করার বিষয়টি আইন বহির্ভূত কিনা- প্রশ্ন করা হলে কোনো উত্তর মেলেনি।
তবে অর্থ পরিচালক দিয়ে বাজেট উপস্থাপনের বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ট্রেজারার অধ্যাপক ড. কামালউদ্দীন আহমদ বলেন, এটা কোনো সমস্যা না। অর্থ পরিচালককে আমি অ্যাসাইন করে দিয়েছি। বাজেট আমি অনুমোদন দিয়েছি। আরেকজন উপস্থাপন করতে পারেন! এসময় আইনে বাজেট উপস্থাপন একমাত্র ট্রেজারার করবেন- জানানো হলে কামালউদ্দিন আহমদ বলেন, না না, করি তো আমিই। কন্ট্রিবিউট করি। আর এটা তো পার্লামেন্ট না। সংসদীয় অধিবেশন না, যে অর্থমন্ত্রীকেই বাজেট উপস্থাপন করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কোনো কিছু নেই।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ সাবেক ট্রেজারার অধ্যাপক ড. সেলিম ভূ্ঁইয়া বলেন, আমি দুই মেয়াদে ৮ বছর ট্রেজারার ছিলাম। ৮ টি বাজেটই নিজে করেছি। আইনেই বলা আছে, বাজেট পেশে ট্রেজারার দায়বদ্ধ থাকবেন। অন্য কারো দিয়ে বাজেট পেশ করার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না।
সার্বিক বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইমদাদুল হক বলেন, বিষয়টি আমারও নজরে এসেছে। গত ৩ বাজেট নিজে কেন করেননি ট্রেজারার মহোদয় বলতে পারবেন। আশা করি আগামী বাজেট তিনি নিজেই পেশ করবেন।